চলতি বর্ষায় যাদের থেকে সাবধান থাকবেন- ৪

প্রকৃতিতে চন্দ্রবোড়ার সাথে এখনো আমার সামনা সামনি দেখা হয়নি, তবে আগামী দুই বছরের মধ‍্যে যেকোনো সময় তার সাথে আমার সামনা সামনি দেখা হয়ে যাবে বলে আশা কিংবা আশঙ্কা করছি ! ছোটবেলায় আব্বার কাছে চন্দ্রবোড়া সাপের সম্পর্কে অনেক ভীতি জাগানিয়া গল্প শুনে মনে মনে সাপটির একটি ছবি কল্পনা করে নিয়েছিলাম, তারপর আবার ভুলেও গিয়েছিলাম সেই ছবি। কোনো অজ্ঞাত কারনে এই সাপটি ধীরে ধীরে বাংলাদেশ থেকে আলোচনার বাইরে চলে যায়। আমার শৈশব আশির দশকের, সেই সময়েই এদেশের মানুষ এই সাপটিকে ভুলে যেতে শুরু করে। আশির দশকেই এদের সংখ‍্যা কমতে কমতে এক পর্যায়ে এরা দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে ধরে নেওয়া হয়। পরে এই ধারণাকে পাকাপোক্ত রুপ দেয় IUCN এই প্রজাতীকে আনুষ্ঠানিক ভাবে বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে। ধরে নেওয়া হয় ২০০৯ সালের আগে প্রায় বিশ থেকে তিরিশ বছর দেশে চন্দ্রবোড়া সাপের কোনো অস্তিত্ব ছিলো না । যদিও পরবর্তিতে জানা গেছে দেশের বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে কোনোদিনই চন্দ্রবোড়া পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়নি, খুব সামান‍্য সংখ‍্যায় হলেও এরা টিকে ছিলো, তবে ঐ সময়ে এদের কামড়ে কোনো মানুষের মৃত‍্যুর ঘটনা ঘটেছে বলে জানা যায়নি । চন্দ্রবোড়া বা রাসেল ভাইপার নতুন করে আলোচনায় আসে প্রথম ২০০৯ সালে, ঐ বছর রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলায় পদ্মা নদীর নিকটবর্তি অঞ্চলে প্রথম রাসেল ভাইপার সাপের কামড়ে মানুষের মৃত‍্যুর খবর পাওয়া যায় এবং রাসেল ভাইপার সাপ উদ্ধার হয়। প্রথম সাপটি উদ্ধার হওয়ার পর থেকেই আমি এই সাপটি সম্পর্কে শৈশবে মনের মধ‍্যে জমে থাকা কৌতুহূলের কারনেই সাপটি সম্পর্কে খোজ খবর রাখতে শুরু করেছিলাম বিভিন্ন মাধমে। পরের বছর রাসেল ভাইপারের কামড়ে রাজশাহী এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে যতদুর মনে পড়ছে দশ জন মানুষের মৃত‍্যুর খবর আসে বিভিন্ন মিডিয়ায়, তার পরের বছর চৌদ্দ জন । প্রায় সবগুলো মৃত‍্যুর ঘটনাই ঘটে পদ্মা নদীর কয়েকশো মিটারের ভেতরে । প্রশ্ন হলো এরা হঠাৎ করে ঐ অঞ্চলে এলো কোথা থেকে ? বাংলাদেশ থেকে রাসেল ভাইপার বিলুপ্ত হলেও ভারতের সীমান্তবর্তি জেলাগুলোতে এরা টিকে ছিলো খুব ভালো ভাবেই। ২০০৯ সালে ভারতীয় অঞ্চল থেকে আসা বন‍্যার পানির সাথে ভেসে প্রচুর সংখ‍্যায় রাসেল ভাইপার সাপ বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে বিশেষ করে পদ্মা নদী ধরে রাজশাহী অঞ্চলে । এরপর থেকেই এরা মুলত পদ্মা নদী ধরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে নতুন নতুন অঞ্চলে। পরের বছর নাটোর থেকে রাসেল ভাইপার উদ্ধারের খবর চোখে পড়ে, তার পরের বছরে খবর আসে পাবনা থেকে, তারপর কুষ্টিয়া, তারপর রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরিয়তপুর হয়ে বর্তমানে একদম সমুদ্র উপকূল পর্যন্ত এরা পৌছে গেছে পদ্মা নদী ধরে, নীবিড় মনোযোগ থাকার কারনে আমি লক্ষ‍্য করেছি এরা বছরে একটি করে জেলা কভার করেছে। কুয়াকাটা থেকে রাসেল ভাইপার উদ্ধার হয়েছে, সুন্দরবনে এরা পৌছে গেছে। পৃথিবীতে হিউম‍্যান মাইগ্রেশনের মতই প্রাণী জগতেও মাইগ্রেশনের ঘটনা একটি চলমান প্রক্রিয়া, রাসেল ভাইপারের এক দশকের ভেতর দেশের অনেক অংশে ছড়িয়ে পড়া এ‍্যানিমেল মাইগ্রেশনের একটি বড় উদাহরণ হতে পারে । সম্প্রতি ঢাকার সাভার অঞ্চল থেকেও রাসেল ভাইপার উদ্ধারের খবর আছে। এত দ্রুত কিভাবে এরা দেশের এতগুলো জেলায় ছড়িয়ে পড়লো সেটা বুঝতে হলে এদের স্বভাব এবং বংশবিস্তার পদ্ধতি আগে জানা দরকার। রাসেল ভাইপার অন‍্য সাপেদের মত ডিম পেড়ে বাচ্চা ফুটায় না, এরা সরাসরি বাচ্চা প্রসব করে, পেটের ভেতরেই এরা ডিম ফার্টিলাইজ করে সরাসরি বাচ্চা প্রসব করে বলে অন‍্য সাপের মত এদের ডিম নষ্ট হয়না। এরা একবারে আশিটি পর্যন্ত বাচ্চা প্রসব করে ! দেশে শিকারী পাখি এবং সাপ খেকো স্তন‍্যপায়ী প্রাণীর সংখ‍্যাও আশংকা জনক ভাবে কমে গেছে বলে এদের প্রসব করা অধিকাংশ বাচ্চাই প্রকৃতিতে টিকে যাচ্ছে, ফলে বিপদ্জনক হারে বাড়ছে রাসেল ভাইপারের সংখ‍্যা ! এটাই ভয়ের ব‍্যাপার ! এদের দ্রুত এক অঞ্চল থেকে আর এক অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে এদের স্বভাবও খুব সহায়ক ভুমিকা পালন করছে, স্বভাবে রাসেল ভাইপার খুবই অলস এবং ঘুমকাতুরে একটি প্রাণী, নদীতে ভাসতে ভাসতেও এরা ঘুমায়, দেখা গেলো একটি কচুরীপানার স্তুপের উপর ঘুমাতে ঘুমাতে পঞ্চাশ কিলোমিটার বা একশো কিলোমিটার দুরে কোথাও উঠলো ! এভাবেই এরা পদ্মা নদী ও তার শাখা-প্রশাখা ধরে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। আমার ধারনা আর দশ বছরে এরা সারাদেশেই পৌছে যাবে। প্রথমেই বলেছি আগামী দুই বছরের মধ‍্যে রাসেল ভাইপারের সাথে আমার সামনা সামনি দেখা হওয়ার আশা কিংবা আশঙ্কার কথা, এটা বলেছি আমার গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া জিকের প্রকল্পের বড় ক‍্যানেল থাকার কারনে। বড় ক‍্যানেলের পানির উৎস পদ্মা নদী, আমার ধারনা পদ্মার পানির সাথে দু'চারটে রাসেল ভাইপারও এতদিনে আমার অঞ্চলে পৌছে যাওয়ার কথা । এই সাপটিকে আমি অন‍্য সকল সাপের চেয়ে বেশি সমীহ করি মুলত এর স্বাভাবের কারনে। আগেই বলেছি এরা খুব ঘুমকাতুরে অলস একটা প্রাণী, শুকনো ঘাসপাতার উপর এমনভাবে ক‍্যামোফ্ল‍্যাজ করে মিশে যায় যে আপনার সামনে শুয়ে থাকলেও খুব খেয়াল করে না দেখলে আপনি বুঝতেই পারবেন না যে আপনার সামনে এরকম ভয়ঙ্কর একটি সাপ আছে! একদমই নড়াচড়া করবে না, এদের গায়ের রং ও শুকনো ঘাসপাতার সাথে একদম মিলে যায়, ফলে মানুষ বা যেকোনো প্রাণী না দেখতে পেয়ে হঠাৎই এদের একদম কাছে চলে আসে এবং তৎক্ষনাৎ এরা কামড় বসিয়ে দেয়, এদের কামড়ের গতিও অন‍্য সব সাপের তুলনায় অনেক দ্রুত গতির ! বিষদাতও দেশের অন‍্য সকল সাপের চেয়ে বড় ! এতটাই বড় যে যদি কেউ এদের ধরে আর তার হাতের আঙুল যদি এর ঠোটের নিচের দিকে থাকে তবে রাসেল ভাইপার তার নিজের থুতনি ফুটো করে আপনার হাতের আঙুলে বিষ ঢুকিয়ে দেবে! অতএব সাবধান, কেউ এদের ধরতে যাবেন না । রাসেল ভাইপার হেমোটক্সিন বিষধারী সাপ। এদের বিষ আক্রান্ত ব‍্যক্তির কামড় খাওয়া হাত বা পা ফুলে উঠে টিস‍্যু গলিয়ে মাংশে পচন ধরিয়ে দেয়, কিডনি এবং ফুসফুস ড‍্যামেজ করে ফেলে। এরা গোখরা সাপের মত ড্রাই বাইটও করে না, প্রায় শতকরা আটানব্বই-নিরানব্বই ভাগ কামড়েই এরা বিষ প্রয়োগ করে দেয়। যথা সময়ে প্রচলিত এন্টিভেনম প্রয়োগ করে বিষ নিয়ন্ত্রন করা গেলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগীর কিডনি এবং ফুসফুস মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়, কিডনি ডায়ালাইসিস করতে করতে দেখা যায় মাস খানেক পরে বেশির ভাগ রোগী মারা যায়! এর চিকিৎসাও বেশ ব‍্যায়বহুল হয়ে যায়। অতএব রাসেল ভাইপারকে স্রেফ এড়িয়ে চলাই ভালো । রাসেল ভাইপার এখন পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া নদীগুলোর আশপাশের কয়েকশো মিটারের ভেতরেই বেশি দেখা যাচ্ছে, এরা নদী থেকে বেশি দুরে এখনো খুব একটা যায়নি। এই অলস মহারাজা শুধু ঘুমায়, যখন এদের খাওয়ার প্রয়োজন হয় তখনো এরা শিকারের খোজে ছুটে বেড়ায় না সাধারনত, একই যায়গায় এ‍্যামবুশ করে বসে থাকে, যখন কোনো শিকার এদের রেন্জের মধ‍্যে আসে তখন ধরে খেয়ে নিয়ে এই নবাব বাহাদুর আবার দুই সপ্তাহের জন‍্য ঐ একই যায়গায় ঘুমিয়ে পড়ে! এক ইঞ্চি নড়াচড়া করতেও চরম আপত্তি ! এখন পর্যন্ত দেশে যারা রাসেল ভাইপারের কামড় খেয়েছে তারা অধিকাংশই নদীর আশপাশের মাছ শিকারী বা নদীজীবি মানুষ। যারা পদ্মা ও এর শাখা নদীগুলোতে মাছ শিকারে যান তাদের একটু বেশি সতর্ক হওয়া প্রয়োজন এদের থেকে। রাসেল ভাইপার সহ বেশিরভাগ সাপে কাটলে যেহেতু রোগীর আক্রান্ত হাত বা পা ফুলে উঠবে সেহেতু হাত পায়ে আঙটি বা বালা বা ব্রেসলেট জাতীয় কিছু থাকলে সাথে সাথে খুলে দিন। তিন চার ইঞ্চি চওড়া কাপড় দিয়ে হালকা করে বেধে দিন। কোনো ভাবেই দড়ি বা ফিতা জাতীয় কিছু দিয়ে টাইট করে বাধা যাবে না, এতে গ‍্যাংগ্রিন হয়ে রোগীর ঐ হাত বা পা কেটে বাদ দেওয়া লাগতে পারে। কোনো ভাবেই যেনো আক্রান্ত হাত বা পা নড়াচড়া না করে সেটা নিশ্চিত করুন, প্রয়োজনে হাত বা পায়ের দুইপাশে দুটো বাশের চটা বা কাঠ দিয়ে বেধে দিন যাতে হাটু বা কনুই ভাজ করতে না পারে। সকল ধরনের ওঝা-বদ‍্য-গাছগাছড়া-হারবাল-ঝাড়ফুক-হাত চালান-তন্ত্রমন্ত্র পরিহার করে যত দ্রুত সম্ভব দ্রুতগামী যানবাহনে নিকটস্থ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলে যান। কোনো কোনো জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসা হচ্ছে ( খোজ নেওয়া সাপেক্ষে ) এক মিনিট সময়ও নষ্ট করবেন না। যথা সময়ে সঠিক চিকিৎসা পেলে রোগী সুস্থ হয়ে যাবে আশা করা যায়। উল্লেখ‍্য: সাপ আমাদের ইকোসিস্টেমের জন‍্য অত‍্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ একটি প্রাণী। সাপ দেখলেই মেরে না ফেলে তাড়িয়ে দিন অথবা কোনো রেসকিউয়ার কে খবর দিন ।

Comments